আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই: ইসলামের ইতিহাসে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই সর্বপ্রথম মুনাফিকীর বহিঃপ্রকাশ ঘটান। যার মুনাফিকীর দরুন স্বয়ং রাসুল সাঃ এর রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল আরবের মাটি, মুসলমানরা সাময়িকভাবে পরাজিত হয়েছিল উহুদের যুদ্ধে ।অথচ এই আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই রাসুল সা এর অনুকরনে সর্বদাই থাকতেন প্রথম সারিতে। দাড়ি, চুল,পোশাক এমনকি নামাজের সময়ও থাকতেন প্রথম সারিতে। অথচ তিনিই ছিলেন মোনাফেক সর্দার।
মোস্তফা কামাল পাশা আতাতুর্ক : কামাল পাশা ছিলেন বিংশ শতাব্দীতে উসমানী খিলাফত ধ্বংসের মহানায়ক! তিনি উসমানি খলিফাদের বিভিন্ন কর্মকান্ডের প্রতিবাদ করেন ইসলামের দোহাই দিয়ে। ইসলামকে সামনে রেখে তিনি তৎকালীন যুবসমাজকে একত্রিত করে খিলাফত ধ্বংস করে নিজে ক্ষমতায় বসেন। তিনি ছিলেন পাক্কা মুসলমান! তুরস্কে তার ক্ষমতা গ্রহণের অভিষেকও হয়েছিল মসজিদে জুমআর সালাত আদায়ের মাধ্যমে ।কিন্তু ক্ষমতায় আরোহন করে তিনি তুরস্ক থেকে ইসলামকে ঝেটিয়ে বিদায় করেন। সেখানে মসজিদে আরবি ভাষায় আযান নিষিদ্ধ করেন, নিষিদ্ধ করেন দাড়ি, টুপি, মাদ্রাসা এমনকি আরবি ভাষায় কুরআন পর্যন্ত নিষিদ্ধ করেন তিনি। আরবি ভাষাকে নিষিদ্ধ করে মুসলানদের প্রায় সাতশত বছরের গৌরবজ্জল ইতিহাসকে নিশ্চিহ্ন করার প্রচেষ্টা চালান। ইসলামকে বিদ্রুপ করে বিকৃত ইতিহাস তৈরি করেন মুসলিম শাসনের স্বর্ণ যুগকে নিয়ে। অথচ কামাল পাশাও ছিলেন একজন পাক্কা মুসলমান! !!
আবুল ফজল : বাদশাহ আকবর দ্বীন্-ই এলাহি নামে একটি নতুন ধর্ম প্রচলন করেছিলেন। যার আইনগ্রন্থের নাম ছিল "আকবরনামা" ।আর এই আইনগ্রন্থের প্রণেতা ছিলেন তৎকালীন আলেমসমাজের মধ্যমনি মুফতি আবুল ফজল। বাদশাহ আকবরের প্রধান সহযোগী ছিলেন এই আবুল ফজল, আর তিনিও ছিলেন পাক্কা মুসলিম ! হক্কানি আলেম!
এখন আসি মুলকথায়, আমি উপরে তিনটি যুগ, আর তিনটি সাম্রাজ্যের উদাহরন দিয়েছি। ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে যাদের নূন্যতম ধারনা আছে তারা জানে এই তিনটি সময় মুসলমানদের কি পরিমান সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন।
উহুদ যুদ্ধে মুসলমানদের হযরত হামজা রা: সহ ৭০জন সাহাবায়ে কেরাম শাহাদাত বরন করেছিলেন শুধুমাত্র আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইর মুনাফিকি আচরনের জন্য। তথাপি রাসুল সা: তার বিরুদ্ধে তেমন কোন একশনে যাননি। বরং শীর্ষস্থানীয় সাহাবায়ে কেরামদের আপত্তি সত্বেও তার জানাযায় ইমামতি করেছিলেন তিনি। এখানে জয়ি হয়েছিল রাসুল সা: এর আদর্শ। মৃত্যু ঘটিয়েছিল প্রতিহিংসার এবং পরবর্তীতে আরো মুনাফিক তৈরি আশংকা।
কামাল পাশা ক্ষমতায় আরোহন করেই ইসলামী খিলাফতকে বাতিল করে সেখানে ধর্মনিরপেক্ষ আইন জারি করেন এবং তার শাসনের ১৫ বছরে তুরস্ককে একটি সেক্যুলর রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলার বীজ রোপন করেন। আজকের তুরস্ককে মিলিয়ে দেখুন। হুম ভালো করে মিলিয়ে দেখুন। যে তুরস্কে আযান ছিল নিষিদ্ধ, কুরআন পড়তে হতো ল্যটিন ভাষায়, মহিলারদের বোরখা পরা দূরে থাক মাথায় হিজাব পরলেও যেতে হতো কোর্টে সেখানে আজ তুরস্কের সংসদে প্রেসিডেন্টের ইমামতিতে নামাজের জামায়াত আদায় হচ্ছে। কারন কি জানেন? কারন কামাল পাশার আদর্শের বিপরীতে সেখানে গড়ে উঠেছিল আরো একটি আদর্শ, ইসলামী আদর্শ। কামাল পাশাকে এই ইসলামী আদর্শ হিংসার বশে দুরে টেলে দেয়নি বরং তাকে জাতীয় বীরের মর্যাদাই দিয়েছে। সেখানে তার জীবনী অধ্যয়ন করা হয়, তার জন্মদিবস, মৃত্যুদিবস পালন করা। তার সম্পর্কে আলোচনা করা হয়।আর সে কারনে আজ সেখানে প্রতিহিংসার অপমৃত্যু ঘটেছে। আর এর নামই আদর্শ। আদর্শের জয়।
আবুল ফজল ছিলেন সম্রাট আকবরের প্রধান পরামর্শদাতা। আর ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজের ইচ্ছামত জীবনযাপন করার জন্য তিনি রচনা করেছিলেন আকবরনামা ( হিন্দু,মুসলিম,বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সকল ধর্মের জগাখিচুড়ি ) নামক ধর্মীয় গ্রন্থ। আর এই আবুল ফজল ছিলেন মৌলানা মুফতি মো: আবুল ফজল নামে পরিচিত। তার সময়ে তিনি মোঘল সাম্রাজ্যের সবচেয় বড় আলেম ছিলেন। অথচ আমরা কয়জন জানি ইনি ছিলেন এত বড় আলেম?
এর কারন হচ্ছে উনার নামের আগে এখর আর কেউ আলেম লিখেন না।তার জীবনি সম্পর্কে কেউ আলোচনা করেন না। উনার সমকালীন হক্কানী আলেমরা পরবর্তীতে তার নামের আগের আলেম শব্দটি মুছে ফেলেন ঘৃণা এবং প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে । আর প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে আবুল ফজলের নামের আলেম শব্দটি মুছে ফেলার কারনে পরবর্তী প্রজন্ম ভুলে যায় মৌলানা আবুল ফজলকে। যার কারনে এই ধরনের গাদ্দার আলেমদের বিরুদ্ধে তেমন শক্ত আদর্শ তৈরি হয়নি। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে আবুল ফজল হয়ে উঠেন সাধারন একজন মুনাফিক । প্রতিহিংসার বশবর্তি হয়ে যদি তার নাম থেকে মৌলানা শব্দটি মুছে না ফেলা হত তাহলে এই সকল গাদ্দার আলেমদের বিরুদ্ধেও সত্যের আলোকবর্তিকা রুপে একটি আদর্শ গড়ে উঠত। প্রজন্মের পর প্রজন্ম জানতে পারত আলেমনামদারী এ সকল গাদ্দারদের।সতর্ক হতে পারত এহেন জাহেলদের কাছ থেকে.
সুতরাং একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমরা আহলে হাদিস,মওদুদিবাদ,ওহাবি,শিয়া,সুন্নী প্রভৃতি আদর্শ নিয়ে মারামারি,ঝগড়াঝাঁটিতে লিপ্ত। একে অন্যকে হুমকি-ধামকি,ক্ষমতার জোরে এই করব সেই করব বলে হুংকার দিচ্ছি। কিন্তু এই সকল আদর্শকে মোকাবেলা করার জন্য আমরা কি কোন আদর্শ জাতির সামনে উপস্থাপন করতে সক্ষম হচ্ছি ? আদর্শের মোকাবেলা আদর্শ দিয়েই করা উচিত। আপনার আদর্শ আপনার কাছে ভালো, উত্তম। সেই আদর্শ প্রচার করার জন্য কি আপনি হিংসার পথ বেছে নিবেন? যদি আপনি এই পথ বেছে নেন তাহলে উপরের ব্যক্তিগণের পরিনতি আপনাকেও হতে হবে , এটা নিশ্চিত মনে রাখবেন।
আদর্শের বাস্তবায়ন একটি সমাজকে, রাষ্ট্রকে নিমিষেই পরিবর্তন-পরিবর্ধন করতে পারে। হোক তা একটি ভালো আদর্শ অথবা মন্দ আদর্শ। তা আদর্শই। আসুন প্রতিহিংসার আদর্শ পরিহার করে নিজ আদর্শ প্রতিষ্ঠার কাজে মনোযোগ দেই। মনে রাখবেন বিরোধীতা করে কোন আদর্শকে কেউ কখনো দমাতে পারেনি, তার পাবলিসিটি বাড়ানো ছাড়া। ইতিহাস এটাই বলে।
অন্য আদর্শকে জোর জবরদস্তি করে সমাজ থেকে কখনই দূরে টেলে দিতে পারবেন না, যতক্ষননা আপনার আদর্শ তার আদর্শের তুলনায় শক্তিশালী হবে। সুতরাং আসুন গাল-মন্দ, গলাবজি, ধাপ্পাবাজি পরিহার করে নিজ আদর্শকে শক্তিশালী করার কাজে মনোযোগ দেই। মহান আল্লাহ আমাদের আলেম সমাজ সহ সকলকে এ বুজ দান করুন আমিন
No comments:
Post a Comment