ইদ মানেই আনন্দ! খুশির শিহরন। নতুন কাপড়ের গন্ধ, সাথে মজাদার খাবারের সুঘ্রাণ। এ যেন প্রাণে অন্য রকম সঞ্চার, তারুন্যের চাঞ্চল্য। দুঃখ, ব্যাথা, বেদনা ভুলার এক অনন্য উদযাপন । ভোরের পাখির সুরেলা কন্ঠ শুনে শুনে প্রাতঃস্নান। অতঃপর ইদগাহে যাবার আয়োজন। নতুন কাপড় আর আতরের ঘ্রাণে স্নিগ্ধ ভোরের হাওয়া। সাদা, কালো, লাল, সবুজ নানা রংয়ের বাহারী পোশাক পরে ইদগাহে জমায়েত। নামাজ শেষে কুতবাহ পাঠে পিনপতন নিরবতায় মাবুদের দরবারে নিজেকে সপে দেওয়ার আপ্রাণ সাধনা। মোনাজাত শেষে সকল ব্যাথা - বেদনা ভুলে, আপন-পর দূৃরে ঠেলে, ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান ঘুচিয়ে একে অন্যকে বুকে টেনে নেওয়ার অপরূপ দৃশ্য। ভালোবাসার এক মিলন মেলা। এই তো ইদ!
এই ইদ। এর সংজ্ঞা একেকজনের কাছে মনে হয় একেক রকম। ছোট্ট বালক, যে কিনা মাত্র বোধশক্তি পেয়েছে তার কাছে ইদ মানে বাবা, চাচা কিংবা বড় ভাইয়ের আংগুলে ধরে রঙিন জামা পরে ইদগাহে যাওয়া। আর অবাক হয়ে জমায়েত হওয়া বিশাল জনগোষ্ঠী দেখা, নামাজের জামায়াতে এক কাতার থেকে আরেক কাতারে ছুটে চলা। এটাই ইদ আনন্দ ।
তার চেয়ে একটু বড় যে কিনা মাঠে খেলতে শিখে গেছে, বন্ধু মানে খেলার সাথী এই বোধটুকু অর্জন করে নিয়েছে তার কাছে ইদ মানে বাবা,চাচা,মামা,ভাই-বোন কিংবা আম্মুর কাছ থেকে সালামী আাদায় করে নিয়ে ইদের মেলায় ঘুরতে যাওয়া। রঙিন বেলুন, খেলনা বন্ধুক কেনার নামই তার কাছে ইদ। সারাদিন খেলার সাথীদের সাথে ঘুরাঘুরি, হৈ হুল্লোড় শেষে নতুন জামায় এক রাশ কাদা-মাটি নিয়ে ঘরে ফেরা। এ এক অন্য রকম আনন্দের ইদ।
কৈশোরের ইদ আনন্দ। এ যেন এক রোমাঞ্চকর জীবন। বাবার কাছে কিংবা মায়ের কাছে বায়না ধরে সালামী আদায়। ইদের আগে নিজের পছন্দমতো জামা-কাপড় কেনা অতঃপর ভোরবেলা গোসল শেষে সেই কাপড় পরে নিজেকে হিরো মনে করে ইদগাহে নামাজ পড়া। নামাজ শেষে বন্ধুদের সাথে নিয়ে দূর-ভ্রমণ। সারাদিনই কাটানো মাস্তি-আড্ডায় আর ঘুরাঘুরিতে। ইদ মানেই বাধন হারা গোল্লাছুট জীবন। এটাই ইদ। ইদের রং।
যৌবনের ইদ। এই ইদের রং মনে হয় একটু ভিন্ন রকম। কারো কাছে রঙিন আবার কারো কাছে ধূসর আবছায়ার প্রতিচ্ছবি। সবার মত ভোরবেলা ইদের আয়োজনে ব্যস্ত থাকলেও থাকেনা চঞ্চলতা, দূরন্তপনা কিংবা গোল্লাছুটের জীবন। চেহারায় স্পষ্ট চাপ থাকে নিশ্চিত - অনিশ্চিত ভবিষ্যতের চিন্তারেখা, থাকে দায়িত্ববোধের এক মহা গুরুত্ব। আবার কেউ হয়তো থাকে উদাসীন। কারো সারাদিন কাটে আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের খোজ খবরে আবার কারো দিন কাটে একাকী শুয়ে বসে কিংবা বন্ধুদের সাথে মনমরা আড্ডায়। সম্পূর্ণ বিপরীত এই ইদ আনন্দ জীবনের ফেলে আসা মঞ্চগুলোর তুলনায়।
বাবাদের ইদ।নস্টালজিক ইদ। বাবা টাকাওয়ালা হউক আর না হউক। সব বাবাদের ইদ মনে হয় একই রকম। শাসকের ইদ। সন্তানের নিকট বাবারা এই দিন চরম স্বৈরাচারী মনে হয়। কেউ অভাবের তাড়নায় সন্তানের চাহিদা পুরনে অক্ষমতার দরুন আবার কেউবা চাহিদা পুরনের পর কড়া নজরদারীর কল্যানেই এই মহা উপাধীতে ভুষিত হয়ে থাকেন বাবাদের অজান্তেই। তাই বলে কি বাবারা বুঝেন না? তা কিন্তু নয়। বাবারাও যে এই স্টেজ ক্রস করে এসেছেন। তাই তারাও বুঝেন, তবুও বাবা হিসেবে শাসন করেন। তাদের করতে যে হয়। তাদের মনে হয় পেছনে চলে যেতে, দূরন্তপনা আর চঞ্চলতায় ভরিয়ে তুলতে এই দিনটিকে, কিন্তু পারেন না। কেন পারেন না তাও মনে হয় তাদের কাছেই অজানা থেকেই যায়। মনে হয় রংহীন ইদ।
দাদদের ইদ। নিরামিশ। অন্যান্য দিনের মতই সাধারন একটি দিন। আমার কাছে তাই মনে হয়। । তবে দাদারা মনে হয় ভোর থেকেই অপেক্ষায় থাকেন কখন নাতি-নাতনিরা আসবে। তাকে আঙ্গুল ধরে ইদগাহে নিয়ে যাবে। এরা কিন্তু নস্টালজিয়ায় ভোগেন না বরং অনাগত দিন নিয়েই শংকায় থাকেন। বাবা থাকতেই নস্টালজিয়াকে বিদায় দিয়ে এসেছেন। বরং এরা এই ইদে থাকেন ছোট ছোট নাতি-নাতনির আহ্লাদে আহ্লাদিত, গল্প শুনানোর জন্য থাকেন মুখিয়ে। অপেক্ষায় থাকেন কখন নাতি-নতনিরা তাকে ঘিরে বসবে৷, বায়না ধরবে গল্প শুনানোর। হয়তো কারো ভাগ্যে তখন জুটে পুত্রবধু কিংবা পুত্রের অবহেলা। তবুও তারা মেনে নেয়। মেনে যে নিতেই হয়।
এই ইদ। প্রতিবছরই আসে আমাদের জীবনে। আসে বছরে দুইবার। নানা রংয়ে, নানা রকম সাঝে। জীবনের অর্থ বুঝিয়ে দিতে আসে। আজ রঙিন কাল ধূসর। এই তো জীবন। এই তো ছুটে চলা চক্রাকারে । এই যে ভাবেন জীবনের নানা স্টেজে নানান রকম রং। হরেক রকম ইদ আনন্দ। কেউ দিয়ে আনন্দিত আবার কেউ পেয়ে কিংবা গ্রহণ করে আনন্দিত। চাইলেও সে আসবে, না চাইলেও সে আসবে। তাকে যে আসতেই হবে নানা রংয়ে নানা রকমে। ছোট-বড়, ধনী-দরীদ্র, সফল-ব্যর্থ সবাইকে এসে সে বলবেই ইদ মোবারক।
No comments:
Post a Comment