আকাশ, নৌ, স্থল সবদিকেই যুক্তরাষ্ট্র গোটা দুনিয়ায় শীর্ষ সামরিক পরাশক্তি একথা সবারই জানা। দেশটির ১ লাখ থেকে ১ লাখ চল্লিশ হাজার টন ওজনের বিশালা বিমানবাহী রণতরী গুলো ৮০ থেকে ৯০ টি অত্যাধুনিক যুদ্ধ বিমান নিয়ে, পশ্চিম আটলান্টিক থেকে দক্ষিণ চীন সাগর পর্যন্ত হন্য হয়ে ঘুরে বেড়ায়। মার্কিন নৌবহরের এধরণের মহাসমুদ্র যাত্রাকে তাঁর "ফ্রিডম অব নেভিগেশন" বলে অবহিত করে।
ছয় থেকে আট বিলয়ন ডলার মূল্যের, এধরণের একেকটি বিমানবাহী রণতরীর দৈর্ঘ্য ৯০০ শ' থকে ১০৮০ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। আর যুক্তরাষ্ট্রের নৌবহরে এমন অন্তত দশটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার বা যুদ্ধবিমানবাহী রণতরী রয়েছে।
এসব নৌবহরকে স্কর্ট বা সঙ্গ দিয়ে যায় মার্কিন ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপ। এধরণের একটি ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপে একাধিক ডেস্ট্রয়ার সজ্জিত থাকে আর একেকটি ডেস্ট্রয়ারে থরে থরে সজ্জিত থাকা বিমান ও যুদ্ধ জাহাজ বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র। ফলে মার্কিন নৌ বহর পশ্চিম আটলান্টিক থেকে দক্ষিণ চীন সাগর পর্যন্ত ঘুরে বেড়ালেও, কোনদেশ তাদের ঢিল পর্যন্ত ছুঁড়তে সাহস পায় না।
তাহলে, ইরান কেন পারস্য উপসাগরে এত বিশাল আকৃতির বিধ্বংসী বিমানবাহিনী মার্কিন রণতরীর মোকাবেলায় ছোট ছোট "মিসাইল স্পিডবোট বোট" বানাচ্ছে?
এর কারণ হল, ইরানিরা ভালোভাবেই জানে যে বৈশ্বিক সামরিক পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাঁরা কনভেনশনাল বা প্রচলিত যুদ্ধে জয় লাভ করতে পারবেনা। আর বড়বড় যুদ্ধ জাহাজ তৈরির প্রযুক্তিগত সক্ষমতা থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের অবৈধ অর্থনৈতিক অবরোধের কারণে এই মুহূর্তে ইরানের সেরকম যুদ্ধ জাহাজ তৈরির অর্থনৈতিক সক্ষমতা নাই।
তাই ইরান কিছুটা আনকনভেনশনাল স্ট্রাটেজি নিয়েই পারস্য উপসাগরের ওয়াশিংটনকে মোকাবেলায় এগোতে চাইছে। এ উদ্দেশ্যে নিয়েই ইরান ছোট ছোট মিসাইল স্পিডবোট গুলো তৈরি করছে যে গুলো অত্যন্ত দ্রুত গতিতে ছুটতে পারে।
এধরনের মিসাইল বোট গুলোথে স্টিলথ মোড দেওয়া থাকে এবং পেছনের প্রায় অর্ধেক অংশ পানিতে ডুবানো থাকে যাতে শত্রর র্যাডার সহজে চিহ্নিত করতে পারে। পেন্টাগনের কর্মকতাদের মত ইরানের এই মুহূর্তে এধরনের চার থেকে পাঁচ হাজার স্পিডবোট রয়েছে। এসব স্পিডবোট গুলোতে মিসাইল লঞ্চার বসানো থাকে যাতে কয়েকশ কিলোমিটার দূর থেকে শত্রুর যুদ্ধ জাহাজ লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ে ধ্বংস করে দেওয়া যায়।
এধরণের হামলার জন্য ইরান সম্ভবত তাদের C802 ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র গুলো মিসাই স্পিডবোট গুলোতে স্থাপন করছে। অত্যন্ত ছোট হওয়ায়, আই আরজিসির তৈরি এসব মিসাইল বোট সাগরের যেকোন জায়গায় ডক বা নোঙর করতে পারে, ফলে তেহরান ওয়াশিংটনের হামলার শিকার হলে গোপন স্থানে মোতায়েন করা এসব শতশত এসব মিসাইল বোট ঝাঁক বেঁধে মার্কিন নৌবহরে কয়েকশ কিলোমিটার দূর থেকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাতে পারবে।
কয়েকশ মিসাইল বোট ঝাঁক বেধে এধরনের হামলাকে সামরিক ভাষায় Swarm strike বলা হয়। এধরণের swarm strike চালিয়ে একসঙ্গে কয়েক শত যুদ্ধ জাহাজ বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে ইরান যদি মার্কিন বিমানবাহী রণতরী ডুবিয়ে দিতে পারে, তবে বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক দম্ভ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে। তাই উদ্বিগ্ন ওয়াশিংটন এখন নতুন সামরিক সমীকরণ সাজাতে বাধ্য হচ্ছে।
অন্যদিকে, মার্কিন অর্থনৈতিক অবরোধের মাঝে, অর্থনৈতিক সংকটে কনভেনশনাল যুদ্ধে যখন তেহরান ওয়াশিংটনের বিরুদ্ধে নৌ সমরে জিততে পারবেনা, সেখানে কেন ইরান বিশাল আকৃতির যুদ্ধ জাহাজের নামে সাদাহাতি তৈরি করবে? সে উদ্দেশ্যই ইরান হাজার হাজার আনকনভেনশনাল মিসাইল স্পিডবোট তেরি করছে। আর, ইরানের এমন আনকনভেনশনাল স্ট্রাটেজি ওয়াশিংটনকে চরম বেকায়দায় ফেলছে।
এম ইউসুফ
ভূ-রাজনীতি ও সামরিক বিশ্লেষক।।।
ছবিতে ইরানিয়ান মিসাইল বোট।