বোবা কান্না
(এক)
" রুপা! শুধু নামে নয়, রুপেও অতুলনীয়। আন্ধার ঘরে যেন এক টুকরো আলোক বাতি। প্রতি কদমে যেন রূপোর ঝিলিক, দেহ ছুয়ে ছুয়ে পড়ছে তার সৌন্দর্য।"
কি হলো ,এভাবে চোখ বন্ধ করে বোকার মত হাসছ কেন? " রুপার মিষ্টি ধমকে আচমকা চমকে উঠল সবুজ। তার প্রিয়তমার কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে হারিয়ে গেছে কল্পনার অচিন জগতে। বুঝতেই পারেনি যে রুপা এসে ঘরে ডুকেছে। সবুজও একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে রুপাকে কাছে ডেকে নেয়।
রুপাও তার প্রিয়তম স্বামীর বুকে মাথা গুজে। সবুজ রুপার মাথায় চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলে "না, ভাবছিলাম আমার বউয়ের কথা, ইহজগতে নিজের অজান্তেই করা কোন মহা পূন্যের প্রতিদান হিসেবে আল্লাহ হয়তো আমায় তোমার মত একটি লক্ষী বউ দিয়েছেন। "
"হয়েছে, হয়েছে আর আহ্লাদি কথা বলতে হবেনা " বলে রুপা উঠতে চাইলেও সবুজ তাকে আরো শক্তভাবে জড়িয়ে ধরে। রুপা এবার নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা না করে আদুরে সুরে বলল -
"একটা কথা বলি, রাগ করবেনা তো? "
"এ কেমন কথা? একটা কেন হাজারটা বল, তুমি বলবেনা তো কে বলবে? " সবুজ বলল।
"না থাক, এখন না অন্য সময় বলব " রুপা বলল।
"কেন অন্য সময় কেন, এখনই বল " নাছোড় বান্ধা হয়ে সবুজ বলল।
সবুজকে আরো শক্তভাবে জড়িয়ে ধরে রুপা বলল -
" না, বলছিলাম মায়ের কথা, তোমার মা আর আমার মা কি ভিন্ন? সেই ছোটবেলাতেই মা হারা হয়েছি ,আলো আধারির মত মায়ের মুখখানাও এখন আর মনে নেই । " বলেই রুপা আচল দিয়ে চোখ মুছে।
সবুজ বলে "কি হয়েছে বলবা তো ?"
" না, তেমন কিছু না, কয়েকদিন যাবৎ মনে হচ্ছে মা আমাকে কেন যেন সহ্য করতেই পারছেন না "
"মা কি তোমায় কিছু বলেছে? "
" না, কিছু বলে নি । তবে,,,,,
" তবে,তবে কি, বল ?
" না, পরে বলব" বলেই রুপা উঠে দাড়ায়, রান্নাঘরে কাজ আছে বলে বেডরুম থেকে বেরিয়ে যায়।
শুক্রবার। সপ্তাহের এই একটি দিনই সবুজ ছুটি পায়। ভাবছিল দিনটি ভালই কাটবে, কিন্তু রুপার এই কষ্ট মাখানো কথা তাকে পীড়া দিতে শুরু করে।
অতীতে ফিরে যায় সবুজ। প্রাইভেট ফার্মে সদ্য চাকরি পাওয়া কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার সবুজের সাথে ইন্টারমিডিয়েট ২য় বর্ষে পড়ুয়া রুপার বিয়ে হয় মাস ছয়েক আগে মায়ের পছন্দতেই। এক দেখাতেই তারও পছন্দ হয়ে যায়, মায়ের চয়েজ আছে বলতেই হয়। বিয়ের পর থেকেই যেন তার সংসারে সুখ আর সুখ। রুপা বয়সে কম হলেও অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সাজিয়ে নিয়েছে আপন সংসার। মাও রুপাকে আপন মেয়ের চাইতেও ভালোবাসেন।
কিন্তু ইদানিং মায়ের যেন কি হয়েছে ।কিছুদিন আগে সেও নিজ কানে শুনেছে মা রুপাকে বকছেন। কিন্তু রুপা তাকে কিছুই বলেনি। সে বুঝতে পারছে দিন দিন বিষয়টি প্রকট আকার ধারন করেছে। সে কি মায়ের সাথে এ বিষয় নিয়ে সরাসরি কথা বলবে? না থাক, মা যদি অন্য কিছু ভাবে। এই ভেবে সে আর এদিকে এগোই নি। রুপার ডাকে তার ভাবনার ইতি ঘটে।
সকালের নাস্তার টেবিলে সবুজ আর রুপা বসে আছে । মায়ের কথা জিঙ্গেস করায় রুপা বলল মা শুয়ে আছেন, পরে নাস্তা করবেন। সবুজ টেবিল থেকে উঠে মায়ের রুমে চলে গেল। দেখল মা পাশ ফিরে শুয়ে আছেন। সে মাকে আস্তে করে ডাক দিল। মাকে নিয়ে এসে একসাথে বসে সকালের নাস্তা করল। সবুজ মায়ের চোখের দিকে একটু ভালোভাবে তাকালে দেখতে পেত মায়ের চোখের নিছে কালো দাগ বসে গেছে বোবা কান্নার অশ্রুজলেে, হারিয়ে গেছে সকল উচ্চাস।
এভাবেই দিনগুলো গত হচ্ছে। আর রুপাও প্রায় নিয়মিত সবুজের কানে মায়ের বিরুদ্ধে দু চারটে কথা দিতে থাকল। নিজের অফিস আর ব্যস্ততায় সেও আর সময়ের সাথে তেমন একটা কথা বার্তা বলতে পারছেনা।
এভাবেই কেটে গেল আরো কয়েকটি মাস। একদিন সবুজ অফিসে ,রুপা ফোন দিয়ে জানালো মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তাই সে এম্বুলেন্স করে মাকে নিয়ে হসপিটালে যাচ্ছে। সে যেন তাড়াতাড়ি চলে আসে। সবুজের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। সে তাড়াহুড়ো করে হসপিটালের ইমার্জেন্সি রুমে গিয়ে পৌছল। দেখতে পেল সেখানে সাদা কাপড়ে আপাদঃমস্তক ডাকা একটি স্ট্রেচারের পাশে দাড়িয়ে রুপা কাদছে। সবুজ আর কিছু ভাবতে পারছে না। তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। সমস্ত রঙিন দুনিয়া নিমিষেই অন্ধকার হয়ে উঠল। হাউ মাউ করে মায়ের পায়ের কাছে হুমড়িয়ে পড়ল সে। রুপা আচল দিয়ে চোখ মুছে সবুজের কাধে স্বান্তনার হাত রাখল।
(দুই)
বিয়ের পর থেকেই আরিফা বানু রুপাকে নিজের মেয়ের মত করেই দেখে আসছেন। তাকে ভালোবাসতেন নিজের ছেলের চাইতেও বেশি। রুপাও প্রথমদিকে তার অনেক যত্ন আত্ন করলেও ধীরে ধীরে যেন সে বদলে যেতে থাকে। আগের মত আর কেয়ার নেয়না। বরং কোন ছোটখাটো কোন কাজের কথা বললেই রুপা সংসারের কাজ আছে দেখিয়ে এড়িয়ে যেতে থাকে। ক্রমেই তা অবহেলায় রূপ নেয়।
ঔষদ শেষ হলে তা আবার আসতে প্রায় সপ্তাহখানেক লেগে যেত। তাও কিছু আসত আবার কিছু থাকত। একসময় যে ছেলে মাকে ছাড়া এক বেলাও খেত না, সেই ছেলেও যেন তাকে ভুলে গেছে। খাবার সময় ছেলের কথা জিঙ্গেস করলে পুত্রবধু ছেলে খেয়ে নিয়েছে বলে জানাত। একাকিত্ব, অপুষ্টিতা আর অসহনিয় মানসিক যন্ত্রণায় তিনি দিনে দিন দুর্বল থেকে হয়ে পড়েন। ছেলের সুখের সংসারের কথা ভেবে তিনিও সব মুখ বুজে সহ্য করে যাচ্ছেন নিববে,। আর নিভৃতে চোখের জল মুছেন।
কয়েকদিন থেকে শরিরে মারাত্নক জ্বর এসেছে। শরিরটা যেন পুড়ে যাচ্ছে। বাথরুমে যাবেন, কিন্তু উঠে দাড়ানোর সাহসটুকু পাচ্ছেন না। পুত্রবধুকে কয়েকবার ডেকে কোন সাড়া না পেয়ে অতি কষ্টে কোন রকমের বাথরুমে ডুকলেন। কিন্তু নিজেকে আর সামলিয়ে রাখতে পারালেন না। মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গেলেন, দরজার এক কোনে মাথা লেগে ফেটে দড়দড়িয়ে রক্ত বেরিয়ে পড়তে লাগল। আরিফা বানু শত কষ্ট করেও আর রুপাকে ডাকতে পারালেননা, মুখ দিয়ে অস্ফুষ্ট গোঙ্গানি ছাড়া আর কিছু বের হচ্ছেনা। চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে আর চোখের সামনে ভেসে উঠছে প্রিয়তম স্বামির মুখ আর ছোট খোকার ছুটোছুটি। কানে প্রবেশ করছে ছেলের প্রাণ খুলে ডাকা "মা", "মা" ডাক। তার ইচ্ছে করছে খোকাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেতে .....
দীর্ঘক্ষণ শ্বাশুড়ির কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে রুপা শ্বাশুড়ির রুমে গিয়ে দেখতে পেল বাথরুমের সামনে পড়ে আছে শ্বাশুড়ির নিথর দেহ।
( তিন)
সবুজ মায়ের লাশের পাশে দাড়িয়ে আছে একেবারে আনমনে। রুপার কান কথায় একসময় সবুজ ভাবছিল মাকে কিছুদিনের জন্য বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসবে। কিন্তু না, মা তাকে সেই সুযোগ না দিয়ে একেবারে চলে গেছেন বিদায় নিয়ে। মাকে চিরতরে এক আন্ধার ঘরে রেখে ফিরে আসল বাসায়। সে যদি নিজের প্রিয়তমার চোখে গভীর দৃষ্টিতে চোখ রাখত, তাহলে দেখতে পেত সেখানে শোকের বদলে খেলা করছে এক পরম প্রশান্তি। সবুজ মাকে যেমন আনসন্ধার এক ঘরে রেখেছে ঠিক তেমনিভাবে এক আন্ধার ঘরে রেখে এসেছে পেছেনের না জানা এক ইতিহাস। যা সে কখনো জানবেনা,জানতে পারবেনা,,,,,,
No comments:
Post a Comment