Saturday, May 16, 2020

অনু গল্প: পরাজিত সৈনিক - মো: ইয়াউমিন কাওসার চৌধুরী


".......বাচ্চা , দেখে চালাতে পারিস না " কলার চেপে কয়েকটা চড়-থাপ্পড় লাগল লাল টি-শার্ট আর জিন্স প্যান্ট পরা নাদুস নুদুস স্মার্ট ছেলেটা। সাথে আরো কয়েকটা গালি ....

নাহ! আমার কিছুই হয়নি। হাতের তালুতে শুধু সামন্য ছিলে গেছে।  লাফ দিয়ে  পড়ে যাওয়ায় রাস্তার পাশের কাদাঁ লেগে গিয়ে সাদা শার্টটা ময়লা হওয়া ছাড়া আমার আর কিছুই হয়নি .........

অফিসে যাচ্ছিলাম।  রিক্সার অপেক্ষা করছি আর গ্রীষ্মের এই তাপদাহে শরীরটা একটু ফুটিয়ে নিচ্ছি আর কি ! এরই মাঝে চাচা মিয়ার খালি রিক্সাটা ভাগ্যের জোরে পেয়ে গেলাম আর অমনিতে চড়ে বসলাম। চাচার বয়স আর কতই হবে? বড় জোর ৬৫!  রিক্সা চালাচ্ছেন, মনে হচ্ছে এই যেন পুকুর থেকে গোসল করে আসলেন, বাসায় যাচ্ছেন কাপড় টা চেঞ্জ করবেন!

মাত্র রিকাবী বাজারের পয়েন্টে মেডিক্যাল রোডে মোড় নিলেন, পেছন থেকে বিরাট একটা ধাক্কা!  মনে হল আমি যেন হাওয়ায় উড়ছি। একেবারেই গিয়ে পড়লাম ড্রেনের পাশে কাদা জলের উপর। যাহোক ঝেড়ে- ঝুড়ে উঠে দাড়াতেই হুঙ্কারটা শুনলাম আর চাচা মিয়ার গালে পালসার চালক, ধনীর দুলালের একটু আদর!  সরাসরিই উপভোগ করলাম!

চাচা প্রতিবাদ করলেন, " আমি তো বাম সাইডেই আছিলাম, আপনিই না পেছন থাইক্যা আইসা ধাক্কা দিলেন ......"
"কি মুখের উপর কথা, আবার তর্ক করে বেটা .......বাচ্চা ..........তরে দেখাচ্ছি মজা " বলেই ঠাস! ঠাস! করে আরো কয়েকটি উত্তম - মাধ্যম চাচার কপালে জুটল আর নাম না নেওয়া আরো কয়েকটি  বংশ পরিচয়ের বুলি।

যেন লংকা বিজয় করেছে , এমন ভাব সাব নিয়ে ছেলেটা বু বু করে বাইকটা নিয়ে চোখের সামনেই চলে গেল।আমি নিশ্চুপ! নির্বাকক।ছেলেটা যাওয়ার পর লোকজন রিক্সা চালককে  ঘিরে হালকা একটা ঝটলা বাধালেন। আমি নিচু মাথা নিয়ে চাচা মিয়ার কাছে আসলাম, বেচারার মুখ পানে তাকাতেই বুকটা ধুক! করে উঠলো। এ কি হাল!  চাচার সারা মুখ রক্তে লাল, ভেজা শার্টটা যেন আর সাদা নয় , লাল রঙের!

তবুও চাচার শরিরের দিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই, দু মুটো অন্ন আহরনের একমাত্র অবলম্বন রিক্সার পেছনের চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া চাকাটার দিকেই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে । আমাকে দেখেই " আপনেই কন আমার কি কোন দোষ আছিল ? আপনে কিছু কইলেন না?" বলে চাচা মিয়া কেদে উঠলেন।

আমি কি বলব? কিই বা বলার আছে?  নিরব, নিশ্চুপ । যেন পরাজিত এক সৈনিক ............

(গল্প-১৯)

Tuesday, May 5, 2020

গল্প : নাবিলের আব্বু



মো: ইয়াউমিন কাওসার চৌধুরী

আজ সকাল থেকেই নাবিলের খুব খুশি লাগছে। আনন্দে তার নাচতে ইচ্ছে করছে আর সুর করে গান গাইতে
 মন চাচ্ছে "তাত দিনা দিন দিন.........' কারন আজ তার প্রথম জন্মবার্ষিকী। জন্মবার্ষিকী জন্য অবশ্য তার খুশি খুশি লাগছে না। খুশি লাগছে অবশ্য অন্য কারনে।
গতকাল রাত্রে যখন তার আম্মু তাকে ভাত খাইয়ে দিচ্ছিল তখন হঠাৎ করেই তাকে বলল " আব্বু তুমি কি জানোকালকে
 তোমার জন্মদিন? " 
নাবিল তখন বলেছিল " দম্মদিন তি আম্মু?" 
তখন তার আম্মু তার আদরের দুলালের কপালে চুমু একে দিয়ে বলেছিল "জন্মদিন হল যেদিন তুমি এই দুনিয়ায় এসেছিলে " 
নাবিল তার আম্মুর এমন কঠিন কথার কোন মানেই খুজে পেলনা। সে ফ্যাল ফ্যাল করে তার আম্মুর মায়াবি মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

সে ভেবে কুল কিনারা করতে পারল না আম্মুর এই কথার অর্থ। সে ভাবনার জগতে হারিয়েই গেল, আর কোন কথা না বলেই
 সুবোদ বালকের মতো খাওয়া দাওয়া শেষ করল।
রাত্রে যখন আম্মু তাকে ঘুম পাড়ানির গান গেয়ে ঘুম
 পাড়াচ্ছিলেন তখন সে আর চুপ রইল না। নাবিল আম্মুকে বলল "আম্মুআমি আদে তৈ তিলাম? "  নাবিলের আম্মু প্রথমে ছেলের এমন প্রশ্ন বুজতে না পারলেও পরক্ষনেই বুঝে নিলেন ছেলের মনের কথাটি। তাই তিনি মজা করেই বললেন " এই কথাতুমি আমার এই পেটের মধ্যেই ছিলে বাবা " বলেই তিনি মুচকি হেসে ছেলেকে 
বুকে জড়িয়ে নিলেন  মায়ের এমন উষ্ণ ভালোবাসায় নাবিলও দুহাতে মাকে জড়িয়ে ধরল। সে মনে মনে চিন্তা করল রাজুদের ঘরে দেখা মুরগির 
বাচ্চাগুলোর কথা।

 রাজুর কথা মনে হতেই তার মনে পড়ে গেল রাজুর আব্বুর 
কথাযাকে সে আন্কেল বলে ডাকে।সে প্রায় প্রতিদিনই দেখে রাজুর আব্বু যখন বাইরে থেকে আসে তখন তার জন্য চকলেটবিস্কিটখেলনা আরো কত কিছুই 
নিয়ে আসে। কিন্তু তার আব্বু কৈ ? তিনি তো এখনো একদিনও নাবিলকে দেখতে এলেন না ...

নাবিল তার আম্মুকে আরো শক্তভাবে জড়িয়ে ধরে। আদুরে তুলতুলে কন্ঠে বলল "আম্মু আমাল আব্বু তৈ?" ।ছেলের এমন প্রশ্নে নাবিলের আম্মু থমথম খেয়ে যান। তিনি কি জবাব দেবেন তাই খুজে পাচ্ছিলেন না। নাবিল  সময় যদি তার মায়ের মুখের দিকে তাকাত তাহলে
 দেখতে পেত তার মায়ের মুখ কেমন কালবৈশাখীর আকাশের রূপ ধারন করেছে। তিন শত কষ্টে নিজেকে সামলিয়ে বললেন "তুমার আব্বুকে 
বুঝি দেখত চাও? "নাবিল মাথা নেড়ে বলল, "হুম দেততে তাই " "ঠিক আছে বাবা তাইলে এখন ঘুমাওকাল সকালেই তুমাকে নিয়ে যাব তোমার বাবার কাছে "
নাবিল খুশিতে কাল সারারাত ঘুমুতে পারে নি।কিন্তু মায়ের বকুনি খাবে বলে ঘুমের ভান করেছে সারাটি রাত্রি। সকাল সাকাল তাই ঘুম থেকে উঠে পড়েছে আজ। 

তার যেন আর তর সহ্য হচ্ছে না। খুশিতে তার আগডুম - 
বাগডুম ৭রে নাচতে ইচ্ছে করছে। সে গতকাল সারা রাত বাবাকে নিয়ে অনেক পরিকল্পনা 
করেছে। 
নাবিল প্লান করেছে বাবা যদি তাকে প্রচুর পরিমানে ক্যান্ডি না দেয়তাহলে সে তার সাথে কথাই বলবে না ......
মা টাও যে কিএত বেলা হয়ে গেল তবুও কোন সাড়া নেই। কখন যাবে বাবার কাছে নিয়ে। তার যে আর দেরি সহ্য হচ্ছে না। বাবার গলা জড়িয়ে ধরবে। বাবার গালে ,নাকেকপালে উম্মা দেবে ঠিক রাজু যেভাবে তার বাবাকে দেয়। রান্নাঘরে নাবিল মায়ের চারপাশে আলতো আলতো পা ফেলে ঘুর ঘুর করতেই থাকে....মায়ের কি আর বুজতে বাকি বাবার মমতা ছাড়া বেড়ে উঠা ছেলেটি আজ কি চায়নাবিলের মাও হাতের কাজে তাড়া দেন। দ্রুত কাজ শেষ করে ছেলেকে গোসল করিয়ে নেন। সাদা পঞ্জাবিপাজামা আর টুপি পরিয়ে দেন হাড়ি থেকে একটু কালি হাতের আঙুলে লাগিয়ে ছেলের কপালের ডান পাশে একটি ছোট্ট বৃত্ত একে দিয়ে বলেন "আমার রাজপুত্র বাবা "

নাবিলের আনন্দ দেখে কে। তার যেন আজকে ঈদের আনন্দ। আনন্দে তার দম প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম। কালো বোরকায় আপদমস্তক ডাকা নাবিলের আম্মু তাকে কোলে তুলে নিলেন। রওয়ানা দিলেন নাবিলের আব্বুর সাথে সাক্ষাত করার জন্য। নাবিলের মনে থেকে থেকে আনন্দের ঝিলিক দিলেও গত রাত থেকে তার মায়ের মনে কেমন অশান্তি বিরাজ করছে। ফর্সা মুখখানা যেন এক অজানা দুশ্চিন্তায় ফ্যাকাসে হয়ে আছে। তিনি তার আদরের দুলালকে কোলে নিয়ে হাটতে হাটতে হারিয়ে গেলেন কল্পনার রাজ্যে।
বেশি দিন আগে নয়বছর চারেক আগের কথা। রকারি প্রাইমারি স্কুলে সদ্য চাকুরি পাওয়া রাহামের সাথে নাফিসার বিয়ে হয়। নাফিসা তখন ডিগ্রী শেষ বর্ষের ছাত্রী। যদিও নাফিসা এই সময়ে বিয়ে করতে মোটেই প্রস্তুত ছিল না।তারপরেও তাকে রাজী হতে হয়েছিল বাবা মায়ের জন্যই। গ্রামে সাধারনত তার বয়সী মেয়ে খুব কমই পাওয়া যাবে যাদের বিয়ে হয়নি। 
মোটামুটি ধুমধাম করেই নাফিসার বিয়েটা হয়ে গেল। চেনা - জানা এক পরিবেশ থেকে সম্পূর্ণ এক অচেনা পরিবেশে এসে নাফিসা তার সংসারকে নিজ কর্মগুণে সাঝাতে শুরু করে দিল। সে ধীরে ধীরে শশুড়-শাশুড়ির মনে জয়গা করে নিল আপন মেয়ের মতই। বিয়ের পর প্রথম প্রথম মা-বাবাকে অনেক মিস করলেও রাহামের মা-বাবার আচরনে নাফিসা তার নিজ বাবা মায়ের অভাবটুকু ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠতে লাগল। স্বামীর সোহাগ আর শ্বশুড় শাশুড়ির ভালোবাসায় তার বেশ আনন্দেই দিন কাটাতে লাগল।
নাফিসার মনে পড়ল সেই রাতটির কথাযেদিন প্রানের স্বামীকে নাবিল তার গর্ভে আসার শুভ সংবাদটি দিয়েছিল। সেদিন সারা রাত্রি রাহাম ঘুমায়নি। তাদের সন্তান ছেলে হবে নাকি মেয়ে হবে। যদি ছেলে হয় তবে কি নাম রাখবে আর মেয়ে হলে কি নাম রাখবে? ?? 
ভাবতে ভাবতে সে রাতটি নির্ঘুমই কেটেছিল দুজনার। অতপর ভোরের আলো ফুটার পর রাহাম যে কান্ডটি করেছিল তা স্মরণ করলে এখনো নাফিসা লজ্জায় লাল হয়ে উঠে....

(চলবে)